সামনে অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে যাওয়ার পথ, পেছনে মচ্ছপুছরের লুকোচুরি খেলা। প্রকৃতি যেন আমাকে খেলার পুতুল পেয়েছে: একদিকে মায়ের হাতের কসা মাংস ভাত আর অন্যদিকে বিরিয়ানি রেখে বলছে যা কোন দিকে যাবি যা ! ছোটবেলায় পাটিগণিতে একটা অঙ্ক ছিলোনা, তৈলাক্ত বাঁশ ধরে বাঁদর উঠছে আর পিছলিয়ে নেমে যাচ্ছে, আমার হয়েছে ওই অবস্থা। এক মিনিট হাঁটি তো পাঁচ মিনিট পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রায় আধ ঘন্টা খেলানোর পর দেবতার একটু দয়া হলো বোধ হয়, মেঘের চাদর দিয়ে মচ্ছপুছরের মুখ পুরো ঢেকে দিলেন। অমনি আগুন লাগা রকেটের মতো সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলাম !
ছবি: ABC যাওয়ার পথ ছবি
আলতো পাহাড়ের ঢালে হালকা চড়াই রাস্তা। চারিদিকে হলদেটে ঘাসের গোছা, তাতে নীল রঙের ছোট ছোটো ফুল। রাস্তার বামদিকে পাহাড়ের বুক চিরে নেমেছে একের পর এক বরফের শিরা। কোনোখানে আবার ছোটো ছোটো গ্লেসিয়ার ! এতক্ষণ রাস্তায় ছিলাম শুধু আমি, অরিত্র আর কিছু পোর্টার। এবারে আমাদের সাথে যোগ দিলো মেঘের দল। যেন রেস লেগেছে কে আগে ABC যেতে পারে ! কিছুক্ষন পর দূরের ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠলো দুটো বাড়ি। এইতো এসে গেছি ! আর বোধ হয় ১০ মিনিট। শরীরে যেটুকু ছিটেফোঁটা শক্তি বাকি ছিল, সেটাও কাজে লাগিয়ে দিলাম।
ছবি: Blue Whistling Thrush
কিন্তু যত এগিয়ে যাই, বাড়ি যেন তত পিছিয়ে যায়। পাহাড়ে মরীচিকা দেখছি নাকি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম ! মুখ বাংলার পাঁচ করে প্রায় ৪০ মিনিট হাঁটার পর এলো একটি সাইন বোর্ড। তাতে লেখা ” NAMASTE/ Annapurna Base Camp (4130 m)/ warmly welcome to all external and internal visitors “. এরপর পড়ল একটা ছোট্ট সিঁড়ি। সেটা ধরে উঠতেই চলে এলাম আমাদের লজের উঠোনে। হিমলয়া থেকে ফোন করে আগে থেকেই রুম বুক করা ছিল। রুমে ঢুকে তল্পিতল্পা যেদিকে ইচ্ছে ছুড়ে দিয়ে আগে পশ্চাৎদেশকে বিছানায় অধিষ্ঠিত করলাম। সে যে কি আরাম। যেন কেউ এক হাতে পালক দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে আর অন্য হাতে পিঠ চুলকে দিচ্ছে। তিনদিন ধরে ল্যাজেগোবরে অবস্থা হওয়ার পর আমরা তাহলে পেরেছি। জয় মা অন্নপূর্ণার জয় বলতে বলতে আমি আর অরিত্র একটা করমর্দন সেরে নিলাম। সাথে পালা করে একে অপরের ঘাড় মর্দন ও চললো বেশ কিছুক্ষণ।
ছবি: ABC
কিন্তু যাকে দেখতে আসা তিনি কই ? চারিদিকে তো শুধু মেঘের ধোঁয়া। বেশ বুঝলাম এই মেঘের দল আসলে এই বিরাট থিয়েটারের ভোলেন্টিয়ার। আগেভাগে ছুটে চলে এসে মঞ্চে পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে যাতে কোনো সিন লিক না হয়ে যায়। সময় এখনো হয়নি। নায়িকা তৈরি হচ্ছেন তাঁর গ্র্যান্ড এন্ট্রির জন্য ! বেলা গড়িয়ে তখন দুটো বাজে। আমাদের বাকি বন্ধুরা তখনো এসে পৌঁছায়নি। আমি আর অরিত্র চলে গেলাম কিচেন কাম ডাইনিং রুমে। ঢুকেই অবাক। যেন মানব মিলনক্ষেত্র। চারিদিকে যারা যারা আগে এখানে এসেছে তাদের স্মৃতিচিহ্ন ছড়ানো। কেউ রেখে গিয়েছে ছবি, কেউ রেখে গিয়েছে টিশার্ট, তো কেউ রেখে গিয়েছে শুধু হাতের লেখায় কিছু মুহূর্ত। কেউ এসেছিল তার হাইপারথাইরয়েড আক্রান্ত বন্ধুকে নিয়ে তাকে খুশি করতে, কেউ এসেছিল অন্নপূর্ণা সামিট করতে গিয়ে মৃত কোনো আত্মীয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্য, তো কেউ এসেছিল শুধু তার জন্মদিন পালন করতে। কত বিভিন্নদেশ বিদেশের লোকজন এখন এক জায়গায় বসে রয়েছে ।
ছবি: অন্নপূর্ণা গ্লেসিয়ার
কেউ তাস খেলছে, কেউ বন্ধুদের সাথে গল্প করছে তো কেউ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। এখানে যে wifi রয়েছে। ৩০০ নেপালি টাকায় একদিন। এলাহী বন্দোবস্ত সব ! খিদেয় আমাদের নাড়িভুঁড়ি হজম হতে আরম্ভ করেছিল, কফি আর ডালভাত দিয়ে কোনোমতে সেটা বন্ধ করলাম ! বেলা ৪টে নাগাদ একে একে সব বন্ধুরা চলে এলো। বেরিয়ে পড়লাম আশপাশ টা একটু তদারক করতে। পশ্চিম দিকে মেঘের চাদর একটু পাতলা হয়েছে। তার মধ্যে দিয়েই উঁকি দিচ্ছে অন্নপূর্ণা গ্লেসিয়ার। একটু এগিয়ে গিয়েই বুঝলাম আমরা কি ভীষণ জায়গায় রয়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তার ঠিক এক দু ফুট দূরে খাড়া ৯০ ডিগ্রি ঢাল সোজা নীচে নেমে গিয়ে মিশেছে অন্নপূর্ণা গ্লেসিয়ারে। গ্লেসিয়াল মোরেন এলাকায় মাঝে মাঝে গ্লেসিয়াল পুল। এই গ্লেসিয়ার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সেই মোদিখোলার যার পাস দিয়ে আমরা পুরো পথ অতিক্রম করে এলাম।
ছবি: অন্নপূর্ণা দক্ষিণ
এই জায়গায় ভয়ের সঙ্গে মিশে যায় সম্ভ্রম। নিজেকে মনে হয় অতি ক্ষুদ্র। প্রকৃতির কাছে আমরা কত শিশু, এইসব ভাবছি আর ঠিক তখন হাজারটা বোমা ফাটার আওয়াজ কানে এলো ! সেই শব্দ যে না শুনেছে তাকে বলে বোঝানো মুশকিল। অন্নপূর্ণায় কোথাও অ্যাভ্যলাঞ্চ হচ্ছে, তারই শব্দ এটা। হাত পা পুরো পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। ভয়ঙ্কর সুন্দর আর কাকে বলে! পাহাড়ের মাধুর্যের রূপটাই আমরা সাধারণত দেখতে পাই, তার যে একটা ধ্বংসাত্মক রূপও আছে সেটা এই পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় ওই আওয়াজ জানান দিয়ে গেলো। অন্নপূর্ণা যেমন তার ছত্রছায়ায় অসংখ্য মানুষকে জীবন দান করেছে, তেমনি অনেক মানুষের জীবন কেড়েও নিয়েছে। প্রতি ১০০ জন সামিট অভিযাত্রীর মধ্যে ৩৫ জন চিরশয্যায় শায়িত হয় এই পর্বতচূড়ায় যা বিশ্বের যেকোনো ৮০০০ মি পর্বতচূড়ার মধ্যে সবথেকে বেশি।
ছবি: ABC থেকে মচ্ছপুছরে ও গন্ধর্বচুলি
কাঁপা কাঁপা পায়ে ওই খাদের ধার থেকে একটু পেছনে সরে এলাম ! পশ্চিম আকাশে তখন মেঘ সরে গিয়ে নীল আকাশের বুকে হাসছে মচ্ছপুছরে ও গন্ধর্বচুলি ( Gandharva Chuli: 6248 m) ! এরপর ধীরে ধীরে মঞ্চে অবতীর্ন হল অন্নপূর্ণা দক্ষিন, হিউনচুলি, সিঙ্গুচুলি এবং আরো অনেক নাম না জানা শ্বেতশুভ্রঃ পর্বতশৃঙ্গ। পুরোটাই আসলে বিরাট পাথরের চাঙ্গড় যাকে বলা হয় অন্নপূর্ণা ম্যাসিফ , তার অংশ। তবে এখনো অন্নপূর্ণা I (8091 m) অন্নপূর্ণা II এর মুখথেকে মেঘের ঘোমটা সরেনি। রাত ৮ টা নাগাদ টুনা স্যান্ডউইচ আর পিজ্জা দিয়ে পেট ভরালাম। স্বাদে শুধু পেট না মন ও ভরে গেল। এগুলো সাজেস্ট করেছিল সেই অর্ণবই। খাওয়ার ব্যাপারে বেটার ওপর এত বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, যদি এরপর সেঁকো বিষ খেতে বলে সেটাও বোধ হয় খেয়ে নেব।
ছবি: প্রথম দেখা অন্নপূর্ণা ১ ও ২
তূরীয় মেজাজে বাইরে বেরোলাম একটু পায়চারি করতে, একটা ছবি চোখের সামনে যেন রামধনু রঙের পিচকারী চালিয়ে দিলো। পরিষ্কার আকাশে চাঁদ উঠেছে, আর সেই আলোয় আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে অন্নপূর্ণা I ও II । সেই প্রথম দেখা, শুভদৃষ্টি আমাদের। শরীরের সমস্ত ব্যাথা যেন কোথায় উবে গেল। ওই ৮০০০ মি এর খাড়া দেওয়াল সেদিন যে মোহময়ী রূপ মেলে ধরেছিল তার বর্ণনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করবো না। কারণ তাতে কিছু আগডুম বাগডুম লেখা হবে, বোঝাতে কিছু পারবো না। শুধু একটাই কথা বলব, সাদা যে কত রঙিন হতে পারে সেটা ওই মুহূর্ত সেদিন আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বাকি কথা না হয় ছবিগুলোই বলার চেষ্টা করুক !!!
ছবি: চাঁদের আলোয় ABC
চলবে……
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ১)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৩)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৫)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৬)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (শেষ পর্ব)
লেখকঃ অবকাশ অধিকারী। পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।