রাতে ঘুমটা ঠিক যুৎসই হলো না। নিদ্রাদেবীর জন্য সুস্বাদু পিজ্জার ভোগ চড়িয়েছিলাম, কিন্তু নিষ্ঠুর দেবী এই অধমকে ফেলে রাত ১:৩০ এ চলে গেলেন। কিছুতেই আর এলেন না। কত রকম সাধ্য সাধনা করলাম। এক থেকে একশ গুনে হাজার অব্দি চলে গেল, কোনো ফল হলো না। হাইগুলোও সব টাটা বাই বাই করে দিয়েছে। একে ছোটো রুমে দুটো বেডে চারজন শুয়ে আছি, লাইন ধরে গুঁতোগুঁতি চলছে, তায় গোটা শরীর ব্যথার ডিপো হয়ে গেছে। নড়লেই মরে গেলুম রে, উরে বাবারে আওয়াজ বেরোচ্ছে। এর ওপর আবার সাবির নাক দিয়ে সমানে কামান দাগছে। বেটা আবার পুরো একটা গোটা বিছানা দখল করে শুয়ে আছে। ইচ্ছে হচ্ছিল উঠে গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দিই ! রেগে মেগে কানে হেডফোন লাগিয়ে বাহুবলী ২ সিনেমার ” কানহা সোজা যারা” গানটা রিপিট মোডে চালিয়ে দিলাম। ওই মিষ্টি আওয়াজের জন্য কিনা জানি না ভোরে একটু চোখের পাতা লাগলো।
ছবি: সেই জলপ্রপাত
সকালে কিন্তু উঠে দেখি শরীরে একটু ব্যথা ছাড়া সেরকম কোনো ক্লান্তি নেই। আসলে হাই অল্টিচুডে অক্সিজেনের অভাবে অল্প ঘুমটাই স্বাভাবিক। এখানে রাতে ২-৩ ঘন্টা গাঢ় ঘুম মানে যথেষ্ট ! নাহলে আমার মতো ছেলে যে কিনা বাড়িতে একদিন ৭-৮ ঘন্টা না ঘুমালে পরেরদিন জ্যান্ত লাশ হয়ে যায়, আজ তো তাকে স্ট্রেচারে করে নীচে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ! (হেলিকপ্টার চড়ার মত সাধ ও সাধ্য কোনোটাই আমার নেই কিনা) ! আজ গন্তব্য সোজা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প। উচ্চতা ৪১৩০ মি। দেরি না করে ৭:২০ নাগাদ রওনা দিলাম। ঠিক করেছিলাম ৭ টায় বেরোব, সেখানে ২০ মিনিট লেট অর্থাৎ আগেরদিনের থেকে অর্ধেক সময় কম লেট। বাঙালি হিসেবে এ এক অভাবনীয় উন্নতি!
ছবি: দেওরালি
ছবি : দেওরালি
হালকা চড়াই রাস্তা। বড় বড় গাছের জঙ্গলের জায়গা নিয়েছে ছোট ছোট গুল্ম আর রডোডেনড্রোন জাতীয় গাছ। সবুজের রং ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে হালকা বাদামি ও হলুদ এ। সূর্য এখনো পূর্ব ঢালের ওপরে উঠতে পারেনি, ফলে ওই ঢাল আক্ষরিক অর্থেই আমাদের ছায়ার ঢাল দিয়েছে। আমরা চলেছি সোজা উত্তর দিক বরাবর। আমাদের ডান পাশে বয়ে চলেছে মোদিখোলা। আর যত এগোচ্ছি পূর্ব আর পশ্চিম দিকের দুই খাড়া পর্বতের দেওয়াল আরো কাছে এগিয়ে আসছে। ঠিক যেন কোনো বিরাট রঙ্গমঞ্চে ঢোকার প্রবেশপথ !
ছবি: মোদিখোলা
হঠাৎ চোখ ঝলসে উঠলো। পূর্ব দিকের ঢালের কোনো খাঁজ দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে পশ্চিম দিকের ঢালের এক জলপ্রপাতে। আর সেই বিকিরণ সোজা চোখ এসে লাগছে। মনে হচ্ছে যেন পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তোধারা।
সময় সকাল ৮:১৫। এসে পৌঁছলাম দেওরালি (Deurali)। উচ্চতা ৩২০০ মি। বেরুবার আগে সাইনবোর্ডে দেখেছিলাম হিমালয়া থেকে দেওরালি পৌছোতে লাগবে দু ঘন্টা। সেটা এক ঘন্টারও কম সময়ে চলে এসেছি ! মনে মনে নিজেকে এবার শেরপারত্ন সম্মানে ভূষিত করে নিলাম।
ছবি: প্রথম দেখা অন্নপূর্ণা III
ক্ষণিকের বিশ্রাম আর একটু জলপান করে নতুন উদ্যমে শুরু হলো আবার পথ চলা। অল্প এগিয়েছি, দেখি রাস্তার সামনে গাছের ডাল ফেলে রাস্তা বন্ধ করা। আর ডানদিকে মাটির ওপর তীরচিন্হ দিয়ে পূর্ব দিকের রডোডেনড্রোনের জঙ্গলে ঢোকার দিক নির্দেশ করা রয়েছে। ব্যাপার কি। ফিরতি ট্রেকারদের জিজ্ঞেস করে জানা গেলো গতকাল একটা বড় ল্যান্ডস্লাইডের জন্য পশ্চিম ঢালের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, তাই রাস্তা ডাইভার্ট করে পূর্ব ঢালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নতুন রাস্তায় অল্প একটু এগিয়ে মোদিখোলার ওপর একটা লোহার ছোট ব্রিজ পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। বুঝলাম ব্যাপারটা শাপে বর হয়েছে।
সূর্য এখন জাস্ট আমাদের ধপ্পা দেব দেব করছে। পশ্চিম দিকের রাস্তায় গেলে চড়া রোদে হাঁটতে হত। তার জায়গায় কি সুন্দর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি। রোদ না লাগায় আগের দিনের স্যাঁতসেঁতে ভাবটা এখানে এখনো যায় নি। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে মচ্ছপুছরেকে দেখতে পেলাম। তবে তার মাথার ওপর সূর্য থাকার জন্য বড় অস্পষ্ট। আর মাছের লেজের আকারটাও এখন আর নেই। দিকভেদে পাহাড় যে বহুরূপী হয়ে ওঠে মচ্ছপুছরে তার বড় প্রমাণ !
প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর এসে পড়লাম আবার মোদিখোলার বুকে। আবার একটা ব্রিজ পেরিয়ে চলে গেলাম পশ্চিম ঢালে। মানে ডাইভার্সান শেষ, আসল রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু। আর ঠিক তখনই চোখের সামনে পাহাড় ফুঁড়ে উদয় হল গঙ্গাপুর্ণা (Gangapurna : ৭৪৫৫ মি) ও অন্নপূর্ণা III ( Annapurna III : ৭৫৫৫ মি )। যেন অন্নপূর্ণা স্যাংকচুয়ারীর দুই দিকে দুই পাহারাদার !
এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা খাড়া চড়াই উঠতে হলো। বেলা তখন ১১:৩০। এসে পৌঁছলাম মচ্ছপুছরে বেস ক্যাম্প (MBC)। উচ্চতা ৩৭০০ মি। চারিদিকে গগণচুম্বী সব প্রকৃতির ইমারত। মাঝে দুটি লজ। এই বিরাটের কাছে মানুষের সব দম্ভ চৌপাট। অজান্তেই সম্ভ্রমে হাত দুটো জড়ো হয়ে কপালে ঠেকে যায়। বেস ক্যাম্প নাম বটে কিন্তু এখান থেকে মচ্ছপুছরে ওঠা যায়না। কারণ মচ্ছপুছরে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। শিবের পীঠস্থান হিসেবে ধর্মীয় গুরুত্বের জন্য এই পর্বতচূড়া আরোহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ ! আর মেঘ আর পাহাড়ের আড়ালে তার রূপ আমাদের দৃষ্টি থেকেও এখন অবরুদ্ধ !
একটা লজে লেখা আছে দেখলাম ” Himalayan Tahr and Himalayan Pheasant can be seen here very often “। আমি কিন্তু চারিদিকে চোখ চারিয়েও একটা পাখি পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারলাম না। ওই লজের মালিককে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা। সে বললো, সব আছে, ভোরে আর সন্ধ্যেতে বেরোয়। কিন্তু বারবেলায় হেলিকপ্টারের আওয়াজের ভয়ে লুকিয়ে পড়ে। আর ঠিক তখনই এই স্বর্গীয় পরিবেশে অসুরের মত হা হা করে হাসতে হাসতে বিকট শব্দে একটা হেলিকপ্টার উড়ে চলে গেল। কি বিচ্ছিরি জিনিস। ইচ্ছে করছিল একটা অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট মিসাইল ছুড়ে মারি ! ইতোমধ্যে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। বৃষ্টি নামার আগেই ABC পৌঁছতে হবে। দেরি না করে এক কাপ গরম কফি পেটে ঢেলে বেরিয়ে পড়লাম। হালকা চড়াই রাস্তা। যেতে হবে পশ্চিম দিক বরাবর। ঠিক করলাম মাঝে কোথাও দাঁড়াবো না। একদম সোজা ABC। আমাদের ফাইনাল অ্যাসেন্ট !
অল্প কিছুদূর উঠে কি মনে হলো পেছন ঘুরে তাকালাম! যা দেখলাম আমার পা দুটো ঐখানেই আটকে গেলো। আমার সামনে চারদিক পুরো সাদা মেঘে ঢাকা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার মাঝে চোখের দৃষ্টি হরাইজনটালের সাথে ৭০ ডিগ্রি কোন করলে দৃষ্টি আকাশের যেখানে পৌঁছায় সেইরকম উচ্চতায় এক ত্রিফলা চূড়া মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মচ্ছপুছরে ! এই ট্রেকে এখনো পর্যন্ত অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত পেয়েছি বা পাবো, কিন্তু আজ থেকে দশ বছর পর কেউ যদি আমায় জিজ্ঞেস করে, প্রথমে এই মুহূর্তটার কথাই মনে আসবে। ওই যে মেঘের কোলের পাথুরে এলাকা, ওখানে যে এখনো পড়েনি মানুষের অহংকারী পা। প্রকৃতির যে খাজানা ওখানে রয়েছে তা যে এখনো মানুষের অজানা। এই রহস্যের যে কি সুতীব্র আকর্ষণ তা কি আর ভাষায় বোঝানো সম্ভব ! মনে হচ্ছে যেন ওখানেই শুয়ে পড়ে দিন রাত ওই লুকোচুরি খেলা দেখি। আমি যেন অবশ হয়ে গেছি। সামনে এগোনোর ক্ষমতা আমার নেই। কোনোরকমে এক পা সামনে দেওয়া মাত্রই আবার পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। পিছুটান কি একেই বলে !!
ছবি: আরোহনের জন্য নিষিদ্ধ মচ্ছপুছরের চূড়া
চলবে……
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ১)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৩)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৫)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (শেষ পর্ব)
লেখকঃ অবকাশ অধিকারী।
পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।
Follow us on
Subscribe and stay up to date.
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।
Mesmerizing pics of Annapurna, left me stunned ….
:) :)