“আমি এক যাযাবর … আমি এক যাযাবর…” খুব ছোটবেলা থেকেই মনের ভেতরটা তোলপাড় করা কিছু সুরের মধ্যে অন্যতম এক সুর। এই সুরই কি আমার ভিতরে কোন বোধ তৈরী করেছে? এই যে আমার ভেতরে এক যাযাবর সত্ত্বা বাস করে সেটার জন্ম কি এই গান থেকেই নয়? “আমি ইলোরার থেকে রং নিয়ে দূরে শিকাগো শহরে দিয়েছি, গালিবের শের তাশখন্দের মিনারে বসে শুনেছি” এই গান শুনেইতো খোঁজ নিলাম ইলোরা কি আর সেই থেকেইতো আমার ভ্রমণ তালিকায় তাজমহলের উপরে ছিল অজন্তা ইলোরার স্থান। কতদিনের ইচ্ছা তাসখন্দের মিনারে বসে শুনবো গালিবের শের যা এখনো পূর্ণ হয়নি। 

আচ্ছা যাযাবর সত্তার কথা বাদ দিলাম। যখন প্রতারিত হয়েছি প্রিয় বন্ধুর দ্বারা, যখন কেউ নিজের স্বার্থে বন্ধুত্ব করেছে, জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত এই আমাকে কত বার আশ্বাস জুগিয়েছে “ বল কি তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী, পার হয় তোমাকে ধরে দূর্বল মানুষ যদি!” কিংবা “ যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ লজ্জা কি তুমি পাবে না!!”  এই লজ্জার কথা মনে পড়লেই ভেতরের দানবটাকে শাসন করা কত সহজ হয়ে যায়। 

তখন একটু একটু বুঝতে শিখেছি বর্ণবাদ। জানছি কালো বা সাদা বলে কিছু নেই, মানুষ শুধুই মানুষ। তাও ছোট্ট মনে কত রকম প্রশ্ন, দ্বিধা। সেসব কিছুইতো এক নিমিষে দূর হয়ে গেল যখন কানে ভেসে এল “আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা, আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো, যদি দিতে পার প্রতিদান যা কিছু চাও হোক অমূল্য পেতেই পার!!!” 

পাইংক্ষং পাড়ার সেই বৃস্টি ভেজা দিনটার কথা ভোলা মুশকিল। ঘুণিঝড় রোয়ানুর আগমনে সারাদিন চলল আকাশের কান্না। আমি তখন সেই পাহাড়ী পাড়ায় মনের আনন্দে নেচে নেচে ঘুরছিলাম আর গাইছিলাম এখানে “বৃস্টি মুখর লাজুক গাঁয়ে, এসে থেমে গেছে ব্যাস্ত ঘড়ির কাঁটা। “ সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাকে সুর দেওয়া হয়েছে আর সেখানেও সেইতো সেই সুরই ভর করলো মাথায়। মনে হল যেন সেই মুহূর্তটার জন্যইতো সেই গানটা গাওয়া…. 

বসে ছিলাম পাহাড়ের গায়ে একটা একাকী জুম ঘরে। একটু ক্লান্ত, জোঁকের কামড়ে রক্তাক্ত। বিধ্বস্ত আমি বসে আছি জানালার পাশে আর সেই মুহূর্তে “ একখানা মেঘ ভেসে এল আকাশে, একঝাঁক বুনোহাঁস পথ হারালো, একা একা বসে আছি জানালা পাশে, সেকি আসে আমি যারে বেসেছি ভালো।” বেজে উঠল মনের ভেতর। 

দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই কত বছর… এখনো নানান অন্যায়, অবিচারে যখন মন কেঁদে ওঠে তখন সেই লাইনগুলোই আউড়াই… “বর্গীরা আর দেয়না হানা নেইকো জমিদার , তবু কেন এদেশ জুড়ে নিত্য হাহাকার!!” 

এইযে মন হরণ করা অসাধারণ সব গান, সুর… তাঁর শ্রষ্ঠা ড. ভূপেন হাজারিকা , তিনি গেয়েছেন মানুষের গান, জীবনের গান। তিনি প্রভাবিত করেছিলেন মনুষ্যস্বত্ত্বাকে। তিনিইতো গেয়েছেন “ আঁকা-বাঁকা পথে মোরা কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই, রাজা মহারাজাদের দোলা, ও দোলা, আমাদের জীবনের ঘামে ভেজা শরীরের বিনিময়ে পথ চলে “ 

অত্যন্ত দরাজ গলার অধিকারী এই কণ্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এই কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পীর জন্ম ভারতের আসামে। অসাধারণ কিছু গান সৃস্টি করে ২০১১ সালে কিডনী বিকল হয়ে ৮৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি। সৌভাগ্য হয়নি সামনি সামনি ভূপেন হাজারিকার গান শুনবার। তাই আসামে যখন গেলাম তখন এই প্রিয় মানুষটির সমাধিক্ষেত্র ঘুরে আসতে ভুলিনি। এক রৌদ্রোজ্জল সকালে উপস্থিত হলাম আসামে অবস্থিত ড. ভূপেন হাজারিকা সমাধিক্ষেত্রের গেটের সামনে। ৬২ একর জায়গা নিয়ে তৈরী এই সমাধিক্ষেত্র। সমাধিক্ষেত্রে ঢুকতেই চোখে পড়ে প্রিয় গায়কের একটি মূর্তি। সেখানে সংক্ষেপে তাঁর জীবনী লেখা আছে। 

সমাধিক্ষেত্রে চারদিকেই হালকা সুরে বাজছিল ভূপেন হাজারিকার জনপ্রিয় গানগুলো।আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল চেনা প্রিয় সুর। মনে হচ্ছিল আশে পাশেই কোথাও হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসেছেন তিনি আর একটার পর একটা গান গাইছেন আমাদের জন্য।  প্রথমেই কানে এলো “ চেনা চেনা সুরটিরে কিছুতে না চিনি, মোর গায়েরও সীমানায় পাহাড়ের ওপারে নিশীত রাত্রি প্রতিধ্বনি শুনি। “ একপাশে ফোরারার পানির প্রবাহও যেন নাচছিল সুরের তালে তালে। 

সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে একটি কলমের ভাস্কর্য। যা প্রতিকী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে সেখানে। একটা ডোমের মত স্থাপনায় রাখা আছে ড. ভূপেন হাজারিকা র দেহাবশেষ। সেখানে জ্বলছে অনন্ত শিখা। এখানে বসে খানিকটা সময় চুপচাপ না কাটালে কিভাবে উপলব্ধি করবো প্রিয় এই গায়ককে?

গানের উপমাগুলো প্রণয়-সংক্রান্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় থেকে সাবলীলভাবে তুলে আনতেন ড. ভূপেন হাজারিকা। তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে লোকসঙ্গীত গাইতেন। তিনি গেয়েছেন জন জীবনের গান, মানবপ্রেমের গান। তার গানে উঠে এসেছে সমাজের নানান বঞ্চনা, অন্যায়, অত্যাচারের কথা। গানে গানে তিনি প্রতিবাদ করেছেন শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তিনি গেয়েছেন “ বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছ কেন?”

আমার প্রকৃতি প্রেম, নতুন নতুন জায়গা দেখার স্বপ্নকে উদ্বুদ্ধ করে সেই সুর, যেখানে তিনি গেয়েছেন “রঙের খনি যেখানে দেখেছি রাঙিয়ে নিয়েছি মন” । আমি সত্যি তাই করেছি যেখানে যত রঙ পেয়েছি সেই রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি নিজের মন। 

গান গেয়ে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৭৭ সালে পদ্মশ্ৰী, ২০০১ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার পাওয়া। ২০০৯ সালে তাকে অসম রত্ন উপাধি দেওয়া হয়। হালকা পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম সমাধিক্ষেত্রে আর ভাবছিলাম ড.ভূপেন হাজারিকার বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনের কথা, যার সঙ্গীত ছুঁয়ে গেছে কোটি মানুষের প্রাণ। কখনো কোন গান করে তোলে বিষন্ন, কখনো প্রতিবাদী। আবার যখন “দরমিয়াঁ” সিনেমার “পিঘালতা হুয়া ইয়ে সামা…. তিতলিয়া ইতনে হে চানচাল কিউ!” এই সুর শোনার সাথে সাথে আমার মনটাও হয়ে ওঠে চঞ্চল এক প্রজাপতি। 

আমি বসে রইলাম সমাধি পাশে। বেজে উঠল “রুদালি” সিনেমার “ দিল হুম হুম কারে…” অজান্তেই ভিজে উঠলো চোখ। মনের ভেতরটায় চলতে লাগল ভীষণ ভাংচুর। এমন একজন মন প্রভাবিত করা গায়ক এক শতাব্দিতে কয়বার দেখা মেলে? আদৌ কি আর মেলে??? 

এবার উঠতে হবে, ফিরতে হবে ঘরে। কিন্তু মন চাইছিল আরো কিছুক্ষণ থাকি সেখানে। সামনের দিনগুলোর জন্য শক্তি, সাহস, স্পৃহা খুঁজে নিতে থাকি গানগুলো থেকে। “নতুন দিনের যেন পদধ্বনি শুনি।মোর গাঁয়েরও সীমানার, পাহাড়ের ওপারে নতুন দিনের যেন প্রতিধ্বনি শুনি।” শুনতে শুনতে ফেলে আসা অতীতকে ভুলে আরো অর্থবহ, সুন্দর,প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা জীবন কাটানোর আগ্রহ যেন খুঁজে পেলাম। 

নাহ এবার উঠতেই হবে। কিছুটা সময় কাটালাম এখানে। কিছুটা সময় শুধুই অনুভবের। মনে মনে ভাবলাম আর একটা গান শুনেই আমি বের হয়ে যাব সমাধিক্ষেত্র থেকে, ঠিক তখন বেজে উঠল “আমরা করবো জয় একদিন, আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয় , আমরা করবো জয় নিশ্চয়। “ সত্যি সমস্ত কস্ট জয় করে সার্থক একটা জীবন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বেরিয়ে এলাম ড. ভূপেন হাজারিকা সমাধিক্ষেত্র থেকে। 

ড. ভূপেন হাজারিকা সমাধিক্ষেত্র

ড. ভূপেন হাজারিকা সমাধিক্ষেত্র

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

দশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপাহাড় পর্বতের পথে দশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস
সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়

About the Author: Aoezora Zinnia

সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস এন্ড ফিস ব্রীডিং বিভাগে কর্মরত আওজোরা জিনিয়া ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। একসময় প্রবাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জিনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন অসংখ্য দেশ। পর্বতারোহণ নিয়েও রয়েছে তার দারুণ দারুণ সব স্বপ্ন। আর সেই পথ ধরেই তিনি ছিলেন মাউন্ট বাটুর, মাউন্ট ফুজি, মাউন্ট কানামো সহ বিভিন্ন পর্বতারোহণ অভিযানে। বনের সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণার প্রতি তীব্র ভালোবাসার টানে সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়ান থেকে পাহাড়, প্রান্তর থেকে প্রান্তর, বুনোপথ থেকে বুনোপথে।

Sharing does not make you less important!

দশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপাহাড় পর্বতের পথে দশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস
সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

দশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপাহাড় পর্বতের পথে দশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস
সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায়

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!