শিয়াউলি বাজারের উচ্চতা ১০৫০ মি। অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণের উদ্দেশ্যে চলছি। আমাদের আজকের গন্তব্য ছোমরং (Chhomrang )। উচ্চতা ২০৫০ মি। মানে প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতায় উঠতে হবে। সময় লাগবে প্রায় ৬ ঘন্টা। প্রিয়া রেস্টুরেন্টের কর্ণধার কিন্তু প্রথমেই অপ্রিয়ের মতো আমাদের উৎসাহের আগুনে এক গামলা ঠান্ডা জল ঢেলে দিল। হাসি হাসি নিষ্পাপ মুখে বলে কিনা ছোমরং তো দূর কি বাত ঝিনুডান্ডা (Jhinnu Danda), যেটা এখান থেকে ৪ ঘন্টার রাস্তা, পৌঁছতে পারলে জীবন সার্থক! ওর দোকানে খেয়ে ট্যাঁকের কড়ি খসালাম আর এই কিনা তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার! আর এক এই বেয়াড়া ব্যাপার হলো এখানে জয়গার দূরত্ব কিমিতে কোথাও বলা নেই, সব সময়ের হিসেবে দেওয়া। বেজায় মুশকিল, কিমিতে হলে তাও রাস্তার একটা আন্দাজ পাওয়া যেত, সময়ে দূরত্বের হিসেবটা বেজায় গোলমেলে। এর আগেও অনেক ট্রেকে দেখেছি গাইড “এই তো অউর পনরা মিনিট ” বলতে বলতে এক ঘন্টা গাধার মতো হ্যাট হ্যাট করতে করতে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছে। তবে দলপতি ওরফে অরিত্র (দলপতি নামটি রামিজের দেওয়া) বলল এটা নাকি মনস্তাত্তিক ব্যাপার, কিমিতে মন দমে যায়, আর ঘন্টায় মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে ! হবে হয়ত, এই অধম আর কতটুকুই বা জানে!

ছবি: পাহাড়ি হোমস্টে

হাম কিসিসে কম নহি গোছের একটা ঠাটবাট নিয়ে জয় মা দুর্গা বলে দুপুর ২:৪০ নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তা বেশ ভালোই। গ্রামের মেঠো পথ। মাঝে মাঝে পাথর দিয়ে সিঁড়ি বানানো। কখনো হালকা চড়াই তো কখনো হালকা উৎরাই। একটু পরপরই একেকটা হোমষ্টে গোছের বাড়ি আসছে। সুন্দর ভাবে সাজানো। বাড়িগুলোর পাথরের উঠোনে কত রকমারি গাছের ফুল। চারিদিকে কত রকমের শব্দ, কখনো ঘন জঙ্গলের ভেতরে বিভিন্ন পাখির কুজন তো কখনো খোলা আকাশের নিচে মোদিখলার গর্জন। সাথে মৃদুমন্দ বাতাসের আলতো চুম্বন। সব মিলিয়ে আহা কি দেখিনু গোছের একটা ব্যাপার স্যাপার !

তালটা কাটলো প্রায় ২ ঘন্টা হাঁটার পর। যখন হাঁটা শুরু করেছিলাম পশ্চিম আকাশের ক্যানভ্যাসে হালকা কালির পোঁচ লাগিয়েছিল ভগবান। এখন দেখলাম কর্তা সেখানে রীতিমত কালির দোয়াতটাই ঢেলে দিয়েছেন। আর সেটা গড়িয়ে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সাথে হওয়ার বেগ বাড়ছে আর গাছেদের দুলুনিও শুরু হয়েছে। এই খেয়েছে। এতদিন কালবৈশাখী হলে চুপটি করে ঘরে বসে জানলার ভেতর দিয়ে মজা দেখতাম আর ভাবতাম আহা গাছেদের কি কষ্ট। আজ গাছগুলোর দুলুনি দেখে মনে হচ্ছে ওরা আসলে আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসছে।

ছবি ২: ট্রেকিং পথ

ঝটপট পনচোটা বের করে পরে নিলাম আর ব্যাগেও রেনকভার লাগিয়ে নিলাম। কিন্তু বিধির লিখন খণ্ডাবে কে! একটু যেতে না যেতেই আকাশের সে কি কান্না শুরু হলো। কতদিনের দুঃখ জমে ছিল কে জানে। এই ধরণের বৃষ্টিতে কোনো কভারই আমাকে কভার করার জন্য যথেষ্ট নয়। হলোও তাই। শুধু ব্যাগ বাদে বাকিটা ভিজে পুরো স্নান করে গেলাম। জুতোর ভেতর তো রীতিমত একটা ছোটখাট সাগর তৈরি হয়ে গেলো। ছলাৎ ছলাৎ করতে করতে কোনো মতে এগিয়ে চললাম। কিন্তু প্রকৃতি যেন আজ গোটা মানবজাতির কুকর্মের প্রতিশোধ আমাদের ওপরেই নেবে ঠিক করেছে। এতটা অপদস্থ করেও তার শান্তি হয়নি এবার শুরু হলো শিলাবৃষ্টি। মাথাটা যা হোক পনচো আর টুপির কল্যাণে বেঁচে গেল কিন্তু দুই হাত তো খোলা। শীলের টুকরোগুলো দু হাতে অনবরত কিল মারতে লাগলো। যেন এক একেকটা সুঁচ ফুটছে। আর সাথে মেঘের একেকটা গুরুগম্ভীর ধমক। মাগো বলে কান্নাটা জাস্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে এসেছে, এমন সময় গতজন্মের পুণ্যের ফলে রাস্তার ধারে একটা কুঁড়েঘরের ছাউনি পেলাম। যে ভগবানকে এতক্ষন গালমন্দ করতে করতে আসছিলাম তাঁকেই এখন ভালোমন্দ বলতে বলতে ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম !

ছবি: বৃষ্টিস্নাত পাহাড়

ছবি: বৃষ্টিস্নাত পাহাড়

আরো প্রায় দশ পনেরো মিনিট এই তান্ডব চালিয়ে প্রকৃতি অবশেষে ক্ষান্ত হলো। সদ্য বৃষ্টিস্নাত সেই পাহাড়ের প্রশান্তি দেখে কে বলবে একটু আগে এই পাহাড়ই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আমাদের স্ফূর্তি হরণ করেছে। পশ্চিম আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে সূর্যমামাও একটু মুচকি হাসল। অতঃপর আমরাও আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটা বলা ভুল, একনাগাড়ে নীচে নামা শুরু করলাম। পৌঁছলাম একটি নদীর বুকে। নাম ক্যুমরং খোলা। লোহার ছোট ব্রিজ আর পাথরের বোল্ডারের ওপর দিয়ে নদীর অপর পারে এসে আমাদের মাথায় হাত। যত টা নেমেছি তার থেকেও বেশি উঠতে হবে। আর এবার ওঠার জন্য রয়েছে স্বর্গের সিঁড়ি। স্বর্গ বলছি এই কারণে যে ঘাড় উঁচু করে যত ওপরেই তাকাই না কেন শুধু ওই পাথরের সিঁড়িই দেখতে পাচ্ছি। সোজা মনে হয় স্বর্গে গিয়েই থেমেছে। কি আর করা উঠতে তো হবেই !

ছবি: শেষ দিনের আলো

সন্ধে ৬:২০। এসে পৌঁছলাম ঝিনুডান্ডা। ৪ ঘন্টার একটু কমই সময় লেগেছে। একটু পা ছড়িয়ে যে বিশ্রাম করবো তারও কোনো উপায় নেই কারণ আমাদের একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আকাশে মোটামুটি মেঘের ভ্রুকুটি মুছে গেছে। কিন্তু দিনের আলোর আয়ু আর বেশিক্ষণ নেই। বড়জোর ২০ মিনিট, তারপরেই ঝুপ করে নামবে অন্ধকার। আজ যদি আমরা ছোমরং না গিয়ে ঝিনুতেই থাকি তাহলে পরেরদিনে গুলোতে অনেক বেশী কষ্ট করতে হবে। আর ঝিনু যে পাহাড়ে ছোমরং ওই একই পাহাড়ের মাথায়। আমরা ঝিনুতে দাঁড়িয়েই ছোমরঙে বাড়ির আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। মানে আমাদের আবার চড়াই উঠতে হবে, ভাঙতে হবে আরো এক স্বর্গের সিঁড়ি। লোকালদের জিজ্ঞেস করে জানলাম পথ দু ঘন্টার, তবে একটু জোরে হাঁটলে ১:৩০ ঘন্টাতেও পৌঁছে যাওয়া যাবে। লোকালরা আমাদের অভিপ্রায় শুনে বললো “আপ লোগ তো বহত স্ট্রং হো !” আমাদের সাথে মজা করা হলো না সত্যি তারিফ করা হলো এই ভাবতে ভাবতে সবাই মিলে পা বাড়ালাম ছোমরঙের উদ্দেশ্যে।

ছবি: স্বর্গের সিঁড়ি

কয়েককদম উঠতে না উঠতেই দিনের আলো গেল মিলিয়ে। জঙ্গলের মাঝে চুঁইয়ে পড়ছে হালকা চাঁদের আলো। আমাদের মাথায় আর হাতে টর্চ। রাতে এই ধরণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা প্রথম। যদিও প্রত্যেকের পা জবাব দিয়ে দিয়েছে। যেটুকু এগোচ্ছি পুরোটাই মনের জোরে। শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে যখন ছোমরঙের একটা হোমস্টের উঠানে তুললাম তখন বাজে রাত ৮:১৫। হোমষ্টের নাম ও সেরকম : হেভেন ভিউ। যদিও পরের দিন বুঝেছিলাম এটা আসলে ছোমরঙের শুরু, একে লোয়ার ছোমরং বলা চলে, আসল ছোমরং আরো কিছুটা উঠতে হত। কিন্তু আমাদের তখন যা অবস্থা ছিল, সামনে মাটন বিরিয়ানির দোকান থাকলেও আর এক ইঞ্চি নড়তাম না।

ছবি: অমৃত

যাইহোক হেভেনের রুমে ঢুকে সবাই ভিজে জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিলাম। রাতে অমৃত অর্থাৎ ভাত, ডাল সবজি খেয়ে যখন উঠোনে বেরোলাম বুঝতে পারলাম হোটেলের নামকরণের সার্থকতা। আকাশ পুরো পরিষ্কার। আর অসংখ্য তারার নীচে কালো পাহাড়ের মাথায় রুপোর মুকুটের মতো বিরাজ করছে মচ্ছপুছরে ! চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত মচ্ছপুছরে। মাছের লেজের মতো দেখতে বলে এই নাম। অনেকে একে ফিশটেল ( fishtail ) মাউন্টেনও বলে থাকেন। কি তার ভুবনমোহিনী রূপ ! কোথায় গেল আমাদের ক্লান্তি! আমরা যে আরো হাজারটা স্বর্গের সিঁড়ি ওঠার জন্য তৈরি ! তখন শুধু একটাই কথা মনে হয়, আমাদের মতো পাগল হয়তো আর কেউ নেই, কিন্তু আমাদের মতো ভাগ্যবানও কি আর কেউ আছে ?

চলবে……

• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ১)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৫)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৬)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৭)
• অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (শেষ পর্ব)

লেখকঃ অবকাশ অধিকারী।
পেশায় প্রকৌশলী, ঝাড়খণ্ডের মাইথনে নিবাস। নেশা ট্রেকিং করা। বছরে অন্তত দু/তিন বার বেরিয়ে পড়েন হিমালায়ের উদ্দেশ্যে।

Follow us on

Subscribe and stay up to date.

BUY YOUR
HAMMOCK
NOW

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)

About the Author: Living with Forest

Sharing does not make you less important!

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ২)
অনন্যা অন্নপূর্ণার চরণেঅনন্যা অন্নপূর্ণার চরণে (পর্ব ৪)

Sharing does not make you less important!

বন, প্রকৃতির এবং পরিবেশের স্বার্থে বেড়াতে গিয়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি এবং যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। অপচনশীল যেকোন ধরনের আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক প্যাকেট, যে কোন প্লাস্টিক এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করুন। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এ পৃথিবীটা সুস্থ রাখার দায়িত্বও আমাদের।

|Discussion

Leave A Comment

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!

Related Posts and Articles

If you enjoyed reading this, then please explore our other post and articles below!